বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক : মানুষসহ সব প্রাণী এ ধরণিতে জন্ম নেয় সীমিত সময়ের জন্য। আর সেই সময় পার হয়ে গেলে তাদের মৃত্যু হয়ে পড়ে অবধারিত, কেননা মৃত্যুই প্রকৃতির সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। প্রকৃতির অমোঘ নির্দেশে মৃত্যু যখন স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে, তখন কারও কিছু বলার থাকে না। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রমে ঘটা মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যু বাংলাদেশে প্রায়ই ঘটে, যার জন্য মূলত কিছু অতিলোভী মানুষের মনুষ্যতাহীনতা দায়ী। গত ১৫ আগস্ট উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের কাজ করার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের চরম অবহেলা, গাফিলতি এবং অসাবধানতার কারণে একটি গার্ডার চলন্ত গাড়ির ওপর পড়ে যাওয়ায় যে পাঁচটি নিরীহ প্রাণ ঝরে পড়েছিল, লোভী মানুষদের উদাসীনতায় কয়েকজন নিরীহ মানুষের অকাল-অপমৃত্যু তারই একটি ঘৃণিত এবং জলজ্যান্ত উদাহরণ। যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে এ অঘটনের জন্য দায়ী করা হচ্ছে সেটি একটি চীনা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিআরটি নামক বাংলাদেশ সরকারের যে সংস্থা তাদের দায় এড়ানোর চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছে, তারা কি সত্যিই দায়মুক্ত থাকতে পারে? তারা বলছে চীনা এই ঠিকাদারি সংস্থাটি অত্যন্ত দুর্বল মানের, চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পটি ছয় বছরে শেষ করার কথা থাকলেও, এই চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুই দফা সময় বাড়ানোর পরে আজ ১০ বছরেও প্রকল্পটি শেষ করতে পারেনি, যার কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জনদুর্ভোগ হয়েছে অকল্পনীয়ভাবে। গত ১০ বছরে যান চলাচলে অসহনীয় বিঘ্ন ঘটেছে। চুক্তি অনুযায়ী যে মূল্যে কাজটি সম্পন্ন করার কথা ছিল, চীনা সংস্থা এখন নিচ্ছে তার দ্বিগুণ। এ সংস্থাকে ঠিকাদারি চুক্তি তো আর আকাশ থেকে কেউ দেয়নি, বিআরটি নামক সরকারি সংস্থাই এ দুর্বল এবং খামখেয়ালিমূলক চীনা সংস্থাকে চুক্তি দিয়েছে। বিআরটি এখন যাকে দুর্বল এবং দায়িত্বহীন প্রতিষ্ঠান বলে আখ্যায়িত করছে, চুক্তি দেওয়ার সময় তারা কি এগুলো বিবেচনা করেনি? তারা কি এ সংস্থার সামর্থ্য, যোগ্যতা এবং কর্তব্যপরায়ণতা যাচাই করে দেখেনি? যদি না করে থাকে তাহলে বিআরটি কি এ খুনের দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে? চুক্তি দেওয়ার পরও বিআরটির আইনি এবং চুক্তিগত দায়িত্ব ছিল ঠিকাদারি সংস্থার কাজ প্রতিনিয়ত তদারকি করা। তারা বলছে তারা নাকি বেশ কয়েকটি চিঠি ঠিকাদারি সংস্থাকে দিয়েছিল। প্রশ্ন, তাই কি যথেষ্ট ছিল? বিআরটি যখন দেখতে পেল ঠিকাদারি সংস্থা কর্তৃপক্ষের সতর্কবাণীতে কর্ণপাত করছে না, তখন কি তাদের দায়িত্ব ছিল না কঠোর হয়ে চুক্তির শর্ত প্রয়োগ করা? আজ আমাদের আইন অনুযায়ী এই চীনা সংস্থা যেসব ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে তাদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য বটে, ক্ষতিপূরণের যে অঙ্ক কয়েক কোটি টাকা হতে পারে। এই চীনা ঠিকাদারি সংস্থা থেকে বিআরটি কি যথেষ্ট গ্যারান্টির টাকা রেখেছিল, যাতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে আদালতের সম্ভাব্য ডিক্রি বাস্তবায়ন করা যাবে? আদালত ক্ষতিপূরণের ডিক্রি দিলে তা পরিশোধের জন্য যথেষ্ট অর্থ এই চীনা সংস্থার বাংলাদেশে রয়েছে কি না, সেটি কি বিআরটি নিশ্চিত করেছিল? এ ঘটনার জন্য যারা দায়ী তারা নিশ্চিতভাবে মারাত্মক অপরাধ করেছেন, যা দন্ডবিধির ৩০৪ ধারামতে শাস্তিযোগ্য। এ অপরাধকে আইনের ভাষায় বলে এমন নরহত্যা, যা ঠিক খুনের পর্যায়ে পড়ে না। তবে সে অপরাধের জন্যও ১০ বছরের সাজা হতে পারে। এ অপরাধ থেকে চীনের ঠিকাদারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শীর্ষ ব্যক্তিরা যেমন রক্ষা পেতে পারেন না, বিআরটির কর্তাব্যক্তিদের অবস্থাও অভিন্ন। বিআরটির কর্তাব্যক্তিদেরও ৩০৪ ধারায় সাজা হতে পারে, তা ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের ডিক্রিও হতে পারে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ক্রেনের ড্রাইভারসহ নয়জন অতি নিম্ন পর্যায়ের ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা রয়ে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনের দৃষ্টিতে ‘যাকে করপোরেট ক্রিমিনাল লাইবিলিটি বলে’ সেই তত্ত্ব অনুযায়ী বিআরটির কর্তাব্যক্তিরাও রক্ষা পেতে পারেন না। একইভাবে চীনা সংস্থার মালিকদেরও চীন থেকে ডেকে এনে তাদের বিরুদ্ধেও ৩০৪ ধারার মামলার বিকল্প নেই। জাতি অত্যন্ত আশান্বিত যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে বিষয়টি নজরে নিয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছেন। কিন্তু আমরা দেখতে চাই প্রতিটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের কাজে লিপ্ত হন। এদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ফৌজদারি এবং ক্ষতিপূরণের মামলা হলে এ ধরনের অতিলোভী, মানুষের জীবনের প্রতি উদাসীন ব্যক্তিরা ভবিষ্যতে সাবধানতা অবলম্বন করবেন। এ ধরনের ঘটনা এটিই যে প্রথম তা নয়। কয়েক বছর আগে সায়েন্স ল্যাবরেটরির উল্টো দিকে একটি স্থাপিত গার্ডার নিচে পড়ে গেলে গাড়িতে বসা এক ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন। এরপর চট্টগ্রামে গার্ডার পড়ে মৃত্যু হয়েছিল কয়েকজনের। গার্ডার অথবা অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী পড়ে গিয়ে অনেককে আহত করেছে। এ অঘটনগুলো নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, যেসব ব্যক্তি বা সংস্থাকে প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি দেওয়া হয়, তারা মোটেও যোগ্য নয়। সোজা কথায় কর্তৃপক্ষ চুক্তি দেওয়ার সময় এসব নির্মাণ ঠিকাদারদের যোগ্যতা, আর্থিক সক্ষমতা, দায়িত্বপরায়ণতা ইত্যাদি বিষয় মোটেও পরীক্ষা করে দেখেন না। অনেকের মতে ঠিকাদার নিয়োগের ব্যাপারে প্রচুর দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন কর্তৃপক্ষ। এই মাত্র সেদিন চকবাজারে একটি কারখানায় আগুন লেগে বেশ কিছু লোকের প্রাণহানি ঘটল। ঢাকার বিভিন্ন কারখানায় আগুন লেগে প্রাণহানির ঘটনাও এটি প্রথম নয়। কয়েক মাস আগে সীতাকুন্ডে একটি কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ঘটার কারণে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। সেখানেও যে বেআইনিভাবে কিছু রাসায়নিক দ্রব্য মজুদ করা হয়েছিল, তা-ও প্রমাণিত। সে বিষয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা আমরা এখনো জানি না। তবে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সবাই আশাপ্রদ। তিনি বলেছেন অনতিবিলম্বে এসব রাসায়নিক কারখানা চকবাজার এবং অন্যান্য এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলা হবে। একইভাবে ঢাকার উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলামের ত্বরিত সিদ্ধান্তও স্বস্তিকর। তিনি যথার্থই এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে বিআরটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকবে।